যশোরেশ্বরী কালী মন্দির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাসাতক্ষীরা জেলা
অবস্থান
অবস্থানঈশ্বরীপুর, শ্যামনগর
দেশ বাংলাদেশ
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
বাংলাদেশে অবস্থান
স্থানাঙ্ক২২°১৮′২২″ উত্তর ৮৯°০৬′৪৬″ পূর্ব / ২২.৩০৬২১৬° উত্তর ৮৯.১১২৭৭২° পূর্ব / 22.306216; 89.112772

যশোরেশ্বরী কালী মন্দির বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার একটি বিখ্যাত মন্দির। এ শক্তিপীঠটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে অবস্থিত। যশোরেশ্বরী নামের অর্থ "যশোরের দেবী"।[১] হিন্দু ভক্তদের জন্য এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

গুরুত্ব[সম্পাদনা]

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞের পর সতী মাতা দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রলয় নৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু দেব সুদর্শন চক্র দ্বারা সতীর মৃতদেহ ছেদন করেন। এতে সতী মাতার দেহখণ্ডসমূহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয় এবং এ সকল স্থানসমূহ শক্তিপীঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।[২]

পুরাণ অনুসারে[সম্পাদনা]

যশোরেশ্বরী কালী মন্দির সনাতন ধর্মালম্বীদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। সারা পৃথিবীতে সনাতন ধর্মের ৫১ পীঠের একটি যশোরেশ্বরী মন্দির। দেশ-বিদেশের বহু সনাতন ধর্মের অনুসারীরা প্রতি বছর শ্যামনগরের ঈশ্বরীপুর যশোরেশ্বরী কালীমন্দির পরিদর্শনে আসেন ও সেখানে দেবীর সন্তুষ্টির জন্য পূজা অর্চনা দিয়ে থাকেন। সনাতন ধর্মালম্বীদের বাইরেও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় অসংখ্য মানুষ বিভিন্ন সময়ে এ কালী মন্দির দর্শন করেন। সনাতন ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস, দেহত্যাগের পর দেবী সতীর শরীর যে ৫১ খণ্ড হয়ে যায় তার পাঁচটি খন্ড বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য অংশগুলো ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তান ও চীনে পড়ে। এর মধ্যে ঈশ্বরীপুর গ্রামে সতীর করকমল বা পাণিপদ্ম পতিত হয়।

শাক্তপীঠ  হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে ভারত উপমহাদেশে দেবতা শিবের স্ত্রী সতীর বিভিন্ন দেহাংশ ছড়িয়ে থাকা পবিত্র স্থানসমূহ। বাংলা ভাষায় একে সাধারণত বলা হয় পীঠস্থান বা ‘মহাপীঠ’। ‘পীঠ’ শব্দের অর্থ ‘বেদি’ বা ‘আসন’ যেখানে বিষ্ণুচক্রে খন্ডে খন্ডে কর্তিত হওয়ার পর দেবী সতীর (দেবী দুর্গার আরেক নাম) দেহখন্ড পৃথিবীতে পতিত হয়েছিল। প্রচলিত অভিমত অনুসারে মোট একান্নটি শক্তিপীঠ

রয়েছে। এই পীঠগুলির যথার্থ অবস্থান নিয়ে তেমন মতৈক্য নেই। মহাপীঠ নিরূপণ নামে একটি জনপ্রিয় প্রাচীন পান্ডুলিপিতে (১৬৯১-১৭২০) এসব পীঠের নাল্লেউলে­খ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে বৃহৎ বঙ্গে এবং এর পরিপার্শ্বের এলাকাগুলিতে অবস্থিত মোট ২৩টি পীঠ শনাক্তীকৃত। এগুলির মধ্যে ১৪টি পশ্চিমবঙ্গে এবং ৭টি বাংলাদেশে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

সংস্কারের পূর্বে যশোরেশ্বরী কালী মন্দির

ধারণা করা হয় যে, মন্দিরটি আনারি নামের এক ব্রাহ্মণ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি এই যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠের ১০০টি দরজা নির্মাণ করেন। কিন্তু মন্দিরটি কখন নির্মিত হয় তা জানা যায়নি। পরবর্তীকালে লক্ষ্মণ সেন ও প্রতাপাদিত্য কর্তৃক তাদের রাজত্বকালে এটির সংস্কার করা হয়েছিল।কথায় আছে যে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি এখানকার জঙ্গল থেকে একটি অলৌকিক আলোর রেখা বের হয়ে মানুষের হাতের তালুর আকারের একটি পাথরখণ্ডের উপর পড়তে দেখেন। পরবর্তীতে প্রতাপাদিত্য কালীর পূজা করতে আরম্ভ করেন এবং এই কালী মন্দিরটি নির্মাণ করেন। যশোরেশ্বরী কালী দর্শনের নাম করে সেনাপতি মান সিংহ প্রতাপাদিত্যের দুর্গের নকশা নিয়ে যান। পরে আক্রমণ করে মোগলরা সেটি জয়লাভও করে। কালীর বিগ্রহের সঙ্গে প্রতাপাদিত্য এবং তার সেনাপতি ও পরামর্শদাতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করেন মান সিংহ। জমিদার বাড়ির মধ্যে অবস্থিত ছিল। তৎকালীন জমিদার বাবু  মায়ের নামে প্রায় ২০০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। কিন্তু আজ প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা জাল দলিল সৃষ্টি করে মায়ের মন্দিরের সব জমি দখল করে ভোগদখল করছে। আজ মায়ের মন্দিরের ইটের দেওয়াল খসে পড়ছে।

শক্তি দেবী ও ভৈরব[সম্পাদনা]

তন্ত্রচূড়ামণিতে বলা হয়েছে—

‘যশোরে পানিপদ্ম দেবতা যশোরেশ্বরী চণ্ডশ্চ ভৈরব যত্র তত্র সিদ্ধ ন সংশয়।’

অর্থাৎ যশোরে সতীর পাণিপদ্ম বা করকমল পড়েছে। দেবীর নাম যশোরেশ্বরী, ভৈরব হলেন চণ্ড।

এই সতীপীঠে কায়মনোবাক্যে পুজো করলে ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয় বলে সর্বসাধারণের বিশ্বাস।

বিগ্রহ[সম্পাদনা]

মন্দির-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মাতৃ প্রতিমার শুধু মুখমণ্ডলই দৃষ্টিগোচর হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর কণ্ঠের নিচে তার শ্রীহস্ত ও শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না। মূর্তির অবয়ব পুরোটাই মখমলে আবৃত। মায়ের মাথার ওপর টকটকে লাল রঙের চাঁদোয়া। কণ্ঠে রক্তজবার মালা ও নানা অলংকার। মাথায় সোনার মুকুট। লোলজিহ্বা দেবীর ভীষণা মূর্তি। মালদার জাগ্রত জহুরা কালীমাতার মুখমণ্ডলের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে যশোরেশ্বরীর। যশোরেশ্বরী মাতা ভীষণদর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে কী অপূর্ব দেবীভাব। ভক্তের পরম আশ্রয়ের শেষ কথা যেন তিনিই।

পূজা[সম্পাদনা]

মায়ের পুজোয় সমবেত ভক্তগণ ফুল, ফল ও নানাধরনের মিষ্টি আনেন। মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে কাঁসার থালা ও মাটির পাত্রে থরে থরে নৈবেদ্য সাজানো হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর পুজো তন্ত্রমতেও হয়।প্রতিবছর মন্দিরে খুব ধুমধাম করে শ্যামাপুজো হয়। মা ভীষণ জাগ্রত। শ্যামাপুজোয় এই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত পুজো দেন। মানত করেন। বড় করে হোমযজ্ঞ হয়। মাকে নানা অলংকারে সাজানো হয়। মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে। ছাগবলি হয়। মন্দিরের বারান্দায় হিন্দু ভক্তদের পাশাপাশি মুসলমান ভদ্রমহিলারা ও মাকে ভীষণ মান্যি করে। মানত করতে আসে। মানত পূরণ হলে এক জোড়া পায়রা মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়। ।

নাটমন্দির ও স্থাপত্য[সম্পাদনা]

মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহ মঞ্চমণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল যেখান হতে দেবীর মুখমণ্ডল দেখা যায়। এটি লক্ষ্মণ সেন বা মহারাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু কারা এটি নির্মাণ করেছিল তা জানা যায়নি। ১৯৭১ সালের পর এটি ভেঙে পড়ে। সেই সুদৃশ্য, লম্বা-চওড়া বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এখন শুধুমাত্র স্তম্ভগুলি দেখা যায়। দু-একটা স্তম্ভ কয়েকশো বছরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোনওরকমে। একদা মন্দিরের চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর ছিল। মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ কালের গর্ভে বিলীন। মন্দিরের নওবতখানা এখন ভগ্নস্তূপ। শ্রীযশোরেশ্বরী মন্দিরের যত শীঘ্র সম্ভব আমূল সংস্কার প্রয়োজন।

নরেন্দ্র মোদীর মন্দির পরিদর্শন[সম্পাদনা]

২০২১ সালে ২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার যশোরেশ্বরী কালী মন্দির পরিদর্শন করেছেন । উপজেলার ঈশ্বরীপুরে অবস্থিত ঐতিহাসিক এই মন্দিরে মোদির আগমন ঘিরে সাজানো হয়েছিল শ্যামনগর কে। ইতোমধ্যে মন্দির ও প্রাচীর রঙ করে প্রাচীরের ভাঙা অংশ মেরামত করা হয়েছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো বটতলা অংশের গর্ত বন্ধ করে ইট-পাথরের মিশ্রণে দৃষ্টিনন্দন বিস্তৃত চাতাল গড়ে তোলা হয়েছে।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলাপিডিয়া থেকে প্রবন্ধ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ নভেম্বর ২০১২ তারিখে
  2. "Introduction and Preface"www.sacred-texts.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 
  3. "যশোরেশ্বরী কালী মন্দিরে পূজা করলেন নরেন্দ্র মোদি"Bangla Tribune। ২০২১-০৭-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

  • Jeshore Khulnar Itihash by Satish Chandra Mitra, pp. 87, 100, 551.
  • Baghrotot Parikraman: Satkhira Zillar Itihash O Oitijhyo by Jyoti Chattopadhyay, p. 105.
  • Sunderban-er Itihash by AFM Abdul Jalil